খাদ্য হিসাবে সামুদ্রিক শৈবালের ব্যবহার
খাদ্য হিসাবে সামুদ্রিক শৈবালের ব্যবহার দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সামুদ্রিক শৈবাল প্রায়শই পাথরের নীচে বা অগভীর পানিতে জন্মে। এটি করার জন্য তারা ভোল্ট ফাস্ট নামক কাঠামো ব্যবহার করে। ভোল্ট ফাস্টগুলি উদ্ভিদের শেকড়ের মত কিন্তু সামুদ্রিক শৈবাল গুলি উদ্ভিদের মতো শিকড়ের মাধ্যমে পুষ্টি গ্রহণ করে না।
আমাদের শৈবাল মানুষের খাদ্য পশুর খাদ্য সার এবং বিভিন্ন জ্বালানি উৎপাদনে
ব্যবহৃত হয়। সামুদ্রিক শৈবাল পরিবেশের জন্য অত্যন্ত উপকারী কারণ এটি বায়ুমণ্ডলে
অক্সিজেন যোগান দেয় এবং পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
পোস্ট সূচিপত্রঃখাদ্য হিসেবে সামুদ্রিক শৈবালের ব্যবহার
খাদ্য হিসেবে সামুদ্রিক শৈবালের ব্যবহার
খাদ্য হিসেবে সামুদ্রিক শৈবালের ব্যবহার খাদ্য শিল্পের আইসক্রিম মসৃন করতে সিরাপ ঘন করতে, ক্যান্ডি বার এবং সালাত ড্রেসিংয়ে ফিলার হিসাবে বাদামী শৈবাল ব্যবহার করা হয় ।কিছু বাদামী শৈবাল প্রজাতি সার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং অন্য গুলি সবজি হিসাবে খাওয়া হয়। লাল শৈবাল প্রায়শই অন্যান্য তীরবর্তী উদ্ভিদের সাথে যুক্ত থাকে। কিছু প্রজাতি প্রাণী শৈবালের সাথে, প্রবাল প্রাচীর এবং দ্বীপ তৈরি করে। কিছু লাল শৈবাল খাদ্য উদ্ভিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয় যেমন আইরিশ শ্যাওলা পুডিং, টুথপেস্ট আইসক্রিম সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়।
তুলনামূলক কম সংখ্যক সবুজ শৈবাল পাওয়া যায়। বেশিরভাগ সবুজ সামুদ্রিক শৈবাল মিঠা পানিতে পাওয়া যায়। একটি সামুদ্রিক প্রজাতি যাকে সামুদ্রিক লেটুস বলা হয়,,আয়োডিন এবং ভিটামিন এ, বি এবং সি সমৃদ্ধ। কিছু উপকূলীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক লেটুস সালাদ এবং স্যুপে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে সামুদ্রিক শৈবালের প্রাপ্তি স্থান
বঙ্গোপসাগরে উপকূলে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ সহ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, ইনানী ও বাঁশখালী মোহনার আশেপাশে পাথুরে ও প্যারাগন এলাকায় জোয়ার ভাটার সময় অধিকাংশ স্থানে সামুদ্রিক শৈবাল দেখতে পাওয়া যায়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রায় ১৪০ ধরনের ও বাঁশখালী মহেশখালী চ্যানেলের মোহনায় ৫ প্রজাতি এবং প্যারাবন এলাকায় ১০ প্রকারের সামুদ্রিক শৈবাল পাওয়া যায়। কক্সবাজার ও পার্বত্য অঞ্চলের রাখাইন ও অন্যান্য উপজাতীয় গোষ্ঠী সালাত ও চাটনি হিসেবে শৈবাল গ্রহণ করে থাকে। স্থানীয় ভাষায় সমুদ্র শৈবাল "হেজালা" নামে পরিচিত।
আমাদের দেশে বাণিজ্যিকভাবে সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদনের তথ্য পাওয়া না গেলেও অনেক আগে থেকেই উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত সামুদ্রিক শৈবাল পাশের অন্যান্য দেশে প্রেরণ হয়। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের শৈবাল গবেষক দল সেন্টমার্টিন দ্বীপ ইনানী বাঁশখালী মোহনা ও টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ শাপলাপুর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৩৮ টি সামুদ্রিক শৈবালের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে সংরক্ষণ করেছেন। এসব নমুনা গুলোর মধ্যে ১৮ টি প্রজাতি বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সামুদ্রিক শৈবালের বিভিন্ন খাদ্য গুণ
সামুদ্রিক শৈবালের খাদ্যমান বা পুষ্টিগুণ প্রকৃতিতে প্রাপ্ত অন্য যেকোনো উদ্ভিদের চেয়ে বেশি। আয়োজনের প্রধান উৎস হল সামুদ্রিক শৈবাল যা মানুষের বুদ্ধিমত্তা বিকাশ সহায়তা করে। অধিকাংশ সামুদ্রিক শৈবাল এবংশৈবালজাত পণ্য মানুষের জন্য খাবার।সামুদ্রিক শৈবাল গৃহপালিত পশুর খাদ্য হিসাবেও ব্যবহার করা যায়। এছাড়া হাঁস-মুরগির খাদ্য, মাছের খাদ, জৈব সার, জৈব জ্বালানি, কসমেটিক সামগ্রী ইত্যাদি অনেক কিছুই সামুদ্রিক শৈবাল থেকে তৈরি হয়।
সামুদ্রিক শৈবালে উচ্চ খাদ্য মানের কারণে বিশ্বব্যাপী শৈবাল উচ্চ মূল্য মানের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের দেশে এখনো সামুদ্রিক শৈবাল মানুষের খাদ্য হিসেবে ওতটা জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে জনসাধারণ সামুদ্রিক শৈবাল বা শৈবালজাত খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তুললে তাদের পুষ্টি চাহিদা যেমন মিটবে তেমনি নানারকম রোগ ব্যাধি হতে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হবে।
সামুদ্রিক শৈবালের ঔষধি গুণাগুণ
সামুদ্রিক শৈবালে রয়েছে অনেক সমৃদ্ধ ঔষধি গুণ যা বর্তমানে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোগ নিরাময়েই পথ্য এবং ঔষধ শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে ।আমাদের দেশে বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানি সামুদ্রিক শৈবাল থেকে ভিটামিন জাতীয় ক্যাপসুল তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছে। লাল ও বাদানি বর্ণের সামুদ্রিক শৈবালে ক্যারোটিন নামক একটি উপাদান আছে যা মানব দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেছেন যে সামুদ্রিক শৈবালে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা মানুষকে দুরারোগ্য রোগ ব্যাধি যেমন - ক্যান্সার, শ্বাসকশষ্ট, হৃদরো্ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস ইত্যাদি থেকে মুক্তি দেয়।বিশ্বের বহু দেশের এই সামুদ্রিক শৈবাল মানুষের খাদ্যে পুষ্টি বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সামুদ্রিক শৈবাল ভালোভাবে পরিষ্কার করে তাজা অবস্থায় সালাদ হিসাবে খাওয়া যায়। যে কোন খাদ্যে অন্যান্য উপকরণের সাথে অল্প পরিমাণ ব্যবহার করে খাদ্য উপাদানের পুষ্টিমান বহুগুন বৃদ্ধি করা যায়। সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে সবুজ শৈবাল সমুদ্রের পানি তাপ শোষণ করে নেই ।এভাবে পানির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে শৈবাল উচ্চ উষ্ণায়ন প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এছাড়াও শৈবাল সমুদ্রের পানি প্রাথমিক উৎপাদনশীলতা বাড়ায়।
সামুদ্রিক শৈবাল চাষের সময় ও স্থান
বাংলাদেশের জলবায়ুতে স্থান ভেদে নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রায় ছয় মাস সামুদ্রিক শৈবাল চাষ করা যেতে পারে। তবে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের সর্বোচ্চ অনুকূল অবস্থা বিদ্যমান থাকে জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাস। নারিকেলের ছোবড়ার রশি ও নাইলনের মাছ ধরার রশির জাল ব্যবহার করে। বাংলাদেশের শৈবাল গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে আনুভূমিক নেট পদ্ধতিতে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে উপকূলের লেগুন বা আশ্রয়যুক্ত স্থান যা সাগরে প্রবল ঢেউ ও স্রোতের প্রভাবমুক্ত, দূষণমুক্ত পানি এবং যে স্থানে জনসাধারণের উপদ্রব কম এমন জায়গা সামুদ্রিক শৈবাল চাষের জন্য উপযুক্ত। সামুদ্রিক শৈবাল চাষের জন্য কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলবর্তী সেন্টমার্টিন বাঁশখালী ও ইনানী এলাকায় জোয়ার ও ভাটা মধ্যবর্তী স্থান নির্বাচন করা হয়। নির্বাচিত স্থান গুলোর মধ্যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পানির তলদেশে বালুকাময় পাথুরে ও প্রবাল দ্বারা আবৃত, বাঁশখালীর পানির তলদেশে কাদা ও বালিযুক্ত এবং ইনানির পানির তলদেশে বালুকাময়, শিলা পাথর, খোলস চূর্ণ ও নুরি পাথরযুক্ত।
সামুদ্রিক শৈবালের চাষ পদ্ধতি
চাষের জন্য নারিকেলের ছোবড়ার তৈরি রশি দ্বারা 4 মিটার দীর্ঘ জাল ও ২০ সেন্টিমিটার ফঁআস যুক্ত আনভূমিকভাবে স্থাপন করা হয়। নতুন জন্ম নেওয়া অল্প বয়স্ক বাড়ন্ত সামুদ্রিক শৈবাল প্রজাতি গড়ে ৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য ৪+ 0.0৫ কেজি বীজ (প্রতি বর্গমিটারে ১+০.০১ কেজি )চাষের জন্য তৈরি করা জালে রশ্মির গেটের ফাঁশে আটকে দেওয়া হয়।
জালটির চারপাশে বাঁশের সঙ্গে ঢিলে করে বেঁধে দেওয়া হয় এবং দশটি প্লাস্টিকের বয়া বা প্লাস্টিক ফ্লোটস এমনভাবে আটকে দেওয়া হয় যাতে জালটি সব সময় ০.৫ মিটার, - ০১ মিটার পানির গভীরতায় থাকে। প্রায় ১৫ দিন পরে সামুদ্রিক শৈবাল যখন ৩০+৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য প্রাপ্ত হয় তখন সেগুলোর গোড়া বাদ দিয়ে আহরণ করা হয়। এভাবে প্রতি ১৫ দিন পর পর আংশিক আহরণ ও দৈনিক হার নির্ণয় করা হয়।
সামুদ্রিক শৈবালের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার
সামুদ্রিক শৈবাল সমুদ্র থেকে সরাসরি খনিজ পদার্থ আত্নীকরণ করে ফলে এটা আমাদের খাদ্য তালিকায় এককভাবে সবচেয়ে পুষ্টিকর খাবার যা অধিক পরিমাণে ভিটামিন ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান সমৃদ্ধ। অনেক সামুদ্রিক শৈবালি মাংসের থেকে বেশি আমিষ ও দুধের চেয়ে বেশি ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। ভরসার কথা হলো এই এত প্রজাতির মধ্যে বলতে গেলে প্রায় সবগুলোই বিষাক্ত নয়। জাপান, চীন এবংকোরিয়ায় সামুদ্রিক শৈবাল খাদ্য হিসেবে ব্যাপক পরিমাণে ব্যবহৃত হয়।
সামুদ্রিক শৈবালের কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতি ক্যান্সার প্রতিরোধী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। গবেষকরা ইতিমধ্যেই টিউমার ও শ্বেত রক্তকণিকা ঘটিত রক্তস্বল্পতার চিকিৎসায় এদের কার্যকর প্রভাব প্রমাণ করেছেন। এটি প্রদাহবিরোধী ও জীবানুবিরোধী উপাদানেও সমৃদ্ধ, যা রোগপ্রতিরোধে ভূমিকা রাখছে। চীন ও জাপানে জনগণের খাদ্যাভাসে সামুদ্রিক শৈবাল রাখায় ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক কম। অনেক সময় ডায়রিয়ার ওষুধ হিসাবেও এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া হাড় ক্ষয় রোধে, ব্রণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে সামুদ্রিক শৈবালের ভবিষ্যত সম্ভাবনা
বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিরাট অংশ উপকূলে বসবাস করে তাদের প্রধান কাজ হল মৎস্য আহরন, মৎস্য বাজার ব্যবস্থাপনা,লবণ চাষ ইত্যাদি। বিশাল সমুদ্রের উপকুলের মানুষের জন্য বিকল্প আয়ের উৎস হতে পারে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ। অল্প পুঁজিতে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ একদিকে যেমন আয়ের উৎস হবে। তেমনি তাদের খাদ্যাভাস পরিবর্তনে উচ্চ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন সামুদ্রিক শৈবাল তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি পূরণ করতে পারে।যুক্তরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর ইউরোপ মহাদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ রয়েছে।
সামুদ্রিক শৈবালে রয়েছে বহুবিধ ব্যবহার। বাদামি ও লোহিত শৈবালের অর্থনৈতিক গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এসব শৈবালের কোষ প্রাচীরের নির্যাসের বিবিধ ব্যবহার রয়েছে। সাধারণত মেমোনিজ,জেলি, ক্রিম, পুডিং,তৈরিতে এদের ব্যবহার রয়েছে । জাপানের 'জমবু' এবং চীনের বিশেষ 'হাইদাই' খাবারের তৈরিতে বাদামি শৈবালের কদর রয়েছে। প্রোটিন, অ্যামোনিয়া অ্যাসিড , ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, ভিটামিন ১২সহ ভিটামিন সি, ডি, কে, খনিজ আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, জিংক সোডিয়াম, পটাশিয়াম, কপা্ সালফার, ম্যাগনেসিয়াম, আয়োডিন ও কোবাল্ট, সামুদ্রিক শৈবাল মানুষের খাদ্য, সার প্রস্তুতির কাঁচামাল, বিভিন্ন ঔষধ তৈরির কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
ইয়োলোপাইসনীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url